Chor (2019)- Review (Bengali)

নাটক ‘চোর’

:: শুভশ্রী নন্দী (রাই)

[শুভশ্রী নন্দী নিয়মিত ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল ও অন্যান্য পত্রিকা জন্য লেখেন এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যানুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন।]


‘চোর’ নাটকটি একটি ‘এক্টিং বেইস্ড, লঘু কমেডি নাটক। অর্থাৎ ‘সংলাপ’ ও ‘অভিনয়’ ভিত্তিক নাটক -যার মূল জোড় নাট্যরূপ, অভিনয় ও পরিচালনায়। ‘দেনাপাওনা’-র মত গম্ভীর নাটকের পর, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখা এবং ডক্টর সৌমিত্র বসুর নাট্যরূপের এই নাটক নির্বাচন-এর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে খুব সুচিন্তিত পরিকল্পনায় নাট্যসন্ধাকে সাজিয়েছেন পরিচালক ডক্টর রক্তিম সেন।
স্বপ্নময় চক্রবর্তী মানেই বোধ। ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর মুন্সীয়ানা সবসময়ই চমকপ্রদ। আনন্দবাজার পত্রিকাতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর ‘সাদা কাক’ নামের ছোট প্রবন্ধ যারা পড়েছেন তাঁরাই জানেন, সামান্য একটা ‘বিষয়’-কে কেন্দ্র করে, তিনি কি অসামান্য আঙ্গিক ধরে, নিপুণ বিবরণ রচনা করতে পারেন। সেই বোধের সম্পূর্ণ নিরিখেই নাট্যকার ডক্টর সৌমিত্র বসু ও পরিচালক ডক্টর রক্তিম সেন নাটকটিকে খুব যত্নশীল হাতে ব্যবহার করেছেন। ফলে দর্শক একটি মাপমত রসবোধের উচ্চশ্রেণীর অভিনয়-সমেত একটি উঁচু মানের নাটক উপহার পেয়েছেন।

শুরুতে ঋচা সরকারের উপস্থাপনা ছিল উজ্জ্বল ।

এবারে একেকটি চরিত্রকে ধরে আলোচনা করা যাক।

ঝাড়ু হাতে মুখ ঝামটা দেয়া পুত্রবধূ-মলিনা-র দায়িত্বশীল অভিনয় শুধু এন্টারটেইনিং বা মনোরন্জকই নয়, দর্শক-হৃদয়ে নাটকটির গোড়াপত্তন করতে সাহায্য করেছে । বুনো ছাপ ছাপের তথাকথিত ‘মেক্সি -র তলায় অসমভাবে দৃশ্যরত লাল সায়া, ঝাঁটা হাতে বিশুদ্ধ এক্সেন্টে খিস্তি-গালি, ঝাড়ু দেয়ার মাঝে মাঝে তক্কো-ঝগড়ার কারণে হাঁপ-ধরা সংলাপ বলা, একদিকে পিন করে ওড়নার মতো করে নেয়া চাঁদর,অন্যদিকটি মাঝে মধ্যে কাঁধে ছুঁড়ে ফেলে অবিন্যস্ততা গোছানো, হাতটি পেছনে নিয়ে বলা, “ঘরে দিব্বি টাকা চলে আসে।”…. সংলাপ নিক্ষেপনের সময় বৌমার হাতের একেকটা ভঙ্গি ও পজিশনিং ছিল দেখার মতো। কাপড়গুলোকে হাত দিয়ে ঝাড়া , ভাঁজ করে রাখা, খাট-চাঁদর ঠিক করা ..সবই নিখুঁত ভাবে মাপ-মাফিক।

বৌমা ও শ্বশুরের সংলাপ বিনিময় যেন তালে-তালি পড়া, যা একাধিক সুন্দর উপভোগ্য ‘নাটকীয় মুহূর্ত’ তৈরী করেছে। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে যে হরিপদর আপাত সিরিয়াস সংলাপে যে মজার উপাদান-নিহিত, তা দায়িত্বনির্ভরতাসমেত নিক্ষেপের গুণে তাঁর ‘সংলাপ’ শ্রোতার কানে পৌঁছেছে হিউমার বা রসবোধের রসায়ণে অসাধারণ ভাবে। তেমনি বৌমার সংলাপের বর্ণময়তার মধ্যে, চোরের স্বোপার্জিত জিনিস পেয়ে খুশি হবার দৃশ্যে, একটা একটা করে বের করে- ” এ তো ‘বড়লোকদের’ জিনিস।”-বলার সময়, সংলাপে অনবদ্য করুণ রসের আবেগ ব্যবহারে, হরিপদ-চোরের পুত্রবধূ অসাধারণ । “পুলিশের কাছে তো যেতে পারছি না।” বলে তাঁর কান্নায় ভেঙ্গে পড়া চিন্তার দৃশ্যটি দারুণ।অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ডাইলগ-ডেলিভারির মুড সুইংয়ে, চরিত্রটি অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে অসামান্যভাবে।
হরিপদ চোর আগাগোড়াই তাঁর চোখ মুখে খুব একটা হাবাগোবা ভাব রক্ষা করেছে।তাঁর প্রত্যেকটা সংলাপ মনোগ্রাহী। এবং অভিনয় এক কথায় অনবদ্য। “শুধু আমার পেছনে ট্যাকা ট্যাকা করে কেন এত? …তাঁর আপাত করুণ মুখনিসৃত শূন্যে ছোঁড়া সংলাপগুলো মাতিয়ে দিয়েছে দর্শকদের।তাঁর কাঁদোকাঁদো সংলাপগুলো এত মনোগ্রাহী ও প্রাণছোঁয়া যে বলার নয়।উদাহরণ: “মিসেস গোয়েঙ্কা, আমার মিসেস?….কি বলছেন?”

হরিপদ-চোরের দ্বিধাবিভক্ত মনের সাথে মানানসই মিউসিক ব্যবহার, দৃশ্যগুলোকে পাপড়ির মত পূর্ণাঙ্গভাবে খুলে মেলতে সাহায্য করেছে।তবে একথা বলতেই হবে যে তাঁর চোখবাঁধার পর থেকে দৃশ্যটি একেবারে পিক বা তুঙ্গে পৌঁছেছে । চরিত্রটির ডিটেইলিং ও অসাধারণ । যেমন চোর দরজা খুলে দেখলো যে ভোর হয়ে গেলো কিনা। কমলির বেনুনি- নাড়ানো শরীরী ভাষা একেবারে চরিত্রানুগ ভাবে যথাযথ। তাঁর ল্যাম্পপোস্ট ধরে বেঁকে দাঁড়ানো …মোটা গলায় সংলাপ নিক্ষেপ- চরিত্রটির সাথে খাপে খাপে মানানসই হয়েছে।“খোঁজ পর্যন্ত নেয় না”- বলে কমলির , হাতের চলন ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি সহ মেক-আপ ও সংলাপ ছিল খুব সুন্দর। দারোয়ান বা পাহারাদারের জরদা খাবার ডিটেলিং ছিল দেখার মতো। খুব ছোট্ট চরিত্র হলেও পাহারাদার, চরিত্রটিকে অসাধারণ ভাবে এস্টাব্লিশ করেছে। তাঁর খৈনি বানানো, পাকিয়ে মুখে দেয়া ও গুঁড়ো ওড়া, -সব মিলিয়ে সে একটা রসেবশের চরিত্র। ওই পেশার দায়িত্বশীল লোকেদের টেনে নাক ডেকে ঘুমের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অল্পসময়ে খুব পাকা অভিনয় সূত্রে দেখিয়েছে চরিত্রটি।
চায়ের দোকানের দৃশ্যটি পরিচালক কর্তৃক সৃষ্ট। নাটকটির হাল্কা চলনে, একটা নৈতিক কাঠামো এনে একটা মানবিক অবয়ব দেখিয়েছে নাটকটিতে।

চায়ের দোকানের মালিক রতন ব্যথিত কমলির জন্য । গরীব হলেও সে বিস্কুটের পয়সা নেয়না কমলির কাছ থেকে, তাঁকে চা খাওয়ায় বিণে পয়সায়। কমলির এই পরিস্থিতির জন্য সে তাঁর ভাইদের শুধু ‘দায়ী’ করেই নয়, ‘মারবে’ বলে ভাবে। আবার চোর হলেও যে বিবেকবোধ থাকে, তা পরিস্ফুট হয় চুরির টাকা কমলি-কে দানের দৃশ্য-সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এই দৃশ্যরচনার মধ্য দিয়ে, এখানে শুধু ওই চরিত্রটিরই নয়, নাটকটিরও ‘বিবেকবোধ’ তৈরী হয়ে যায় —নাটকটির হাল্কা চলনে একটা গভীরতার প্রকাশ পায়, যা ভারসাম্যতা রক্ষা করে। সাথে এটাও পরিস্ফুট করে যে, যাদের আমরা তথাকথিত ‘নীচুতলা’-র মানুষ বলে চিন্হিত করি, তাঁদের সমাজবদ্ধ জীবনে ‘আন্তরিকতা-পরোপকার’ ইত্যাদি মানবিক মূল্যবোধ এখনো অটুট —যে পথ থেকে তথাকথিত ‘সভ্যতা’-র নামে ‘সবুজ’ থেকে নিজেদের নির্বাসিত ও বিচ্ছিন্ন করে, সাগ্রহে স্বেচ্ছা বন্দীত্ব আলিঙ্গন করা বহুতল-বাসিন্দা আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। চায়ের দোকানের মানকে -র ‘বাউর’ (বাবুর) সাথে চলে যা, ‘পয়োজনে’ , সাধে। ..ইত্যাদি দোকানের কর্মীটির ভাষার ক্ষেত্রে অপভ্রংশতায় অপিনিহিতি ও অভিশ্রূতি ব্যবহার, অভিনয়ের সাথে খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে।

বস চরিত্রটি খুব কমান্ডিং। সে ও তাঁর দুই সহযোগী রন্টা ও মন্টা-র পেশা: কিডনাপিং বা অপহরণ। বস হচ্ছেন মাস্টার প্ল্যানার। তাঁর দুজন সহকারী অনুগামী ‘সাকরেদ’ রয়েছে যারা তাঁর নির্দেশ পালন করে থাকে। কিডনাপিং-এর ডিটেল পরিকল্পনা সে জানে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ‘একশন’ সংক্রান্ত কাজ চালানো খবর সে শুধু সরবরাহ করে । নিরাপত্তার কারণেই বিশদ পরিকল্পনা না বলে, প্রয়োজন মাফিক অংশটি সে ভাগ করে নেয় অধস্তন গুন্ডাদের সাথে, -যেটুকু ‘একশন প্ল্যান’-এর জন্য জরুরী। তাতে ফাঁক থেকে যাওয়াতেই, ধোপার সূত্রেপ্রাপ্ত পোশাকের বিবরণ সমেত খবর এবং চোরের চুরি করে পরিহিত জগিং-এর ট্র্যাকস্যুট এর ঘটনার ঘনঘটায়, গোলযোগ বেঁধে গিয়ে, বিভ্রান্তি ঘটে যায়- সঠিক মানুষ মিস্টার গোয়েঙ্কার চিন্হায়নে।

বস্-এর অভিনয় সত্যিই দারুন। বসের দুই সাগরেদও তথৈবচ। বস অনবদ্য। “মিসেস গোয়েঙ্কা নামটা কি আপনার?”— চরিত্রটির বাচনভঙ্গি খুব দর্শকদের ‘আগ্রহ’ ধরে রাখার মতো। ‘বিধবা’! বলে মুখ হা করে তাজ্জব হবার অভিব্যক্তি বহুদিন মনে থাকবে। বসের বডি ল্যাংগুয়েজ, শরীরী ভাষা, স্ল্যাং সমস্তটাই চমৎকার চরিত্র মাফিক। মিসেস গোয়েঙ্কা, হরিপদ চোর ও বস্ -এই ত্রিকোণ দৃশ্যটা তালিতে তাল মেরে জমে উঠেছিল , দুতরফের ফোনের বাক্যালাপ ও মুখোভঙ্গির প্রতিক্রিয়া অসাধারণ। মিসেস গোয়েঙ্কা-র ‘কিডন্যাপ হয়েছে,বেশ হয়েছে।’-এই বাক্যবন্ধটিতে অভিনয় শৈলীর রসবোধ বা হিউমার পুরো ব্যবহৃত হয়েছে।তাঁর চরিত্রের ভেতরে ঢুকে সাবলীল অভিনয় দেখার মত। খুব নজর-কাড়া অভিনয় তাঁর সহজাত।

দুই মাতালের অভিনয় ছিল অসাধারণ। ব্যানার্জী ও গুপ্তা দুজনেই পার মাতাল কিন্তু দুই ভিন্ন আঙ্গিকে খুব সুন্দর অভিনয় করেছে। দুই মাতালের অভিনয়ে পরিচালকের নির্দেশনার স্টাইল খুব স্পষ্ট হয়েছে।
বিব্রত ড্রাইভার শুকুনের স্বগতোক্তি মেশানো ভ্যাবাচ্যাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ অভিব্যক্তির প্রকাশ সে সুন্দর ভাবে করেছে। একদিকে মিসেস গোয়েঙ্কার আধিপত্য ও তাঁর আদেশ পালন করে স্পাই এর কাজ করা,আবার আনুগত্য বজায় রাখতে খোশামোদ—-অন্যদিকে মিস্টার ও মিসেস গোয়েঙ্কার সম্পর্কের মধ্যে পড়ে একটা দমচাপা অবস্থার শিকার হিসেবে সে তাঁর অবস্থানটি খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে।
এই নাটকে প্রপস্ চরিত্রের মতই যেন শক্তপোক্ত ঠেকেছে। উনুন, আগুন,রেডিও, ঝাঁপ, স্টোভ, কেটলি, হালের ‘পরিবর্তন’-এর কলকাতার ‘ত্রিফলা’ আলো, দৃশ্যবিভাজনের জন্য তৈরী ক’টি সিড়ি ভেঙে ওঠা দরজাটি, -এসবের ডিটেইলিং ছিল নিখুঁত।গোছানো অথচ অবিন্যস্ত আলনা যেখানে গামছা, ধুতি, বেডশিট, চাদর সব শোভা পাচ্ছে, আবার ভাজ করে রাখলে বিন্যস্ত ঠেকছে। তাই সেট, কসটিউম ও মেক্প্র আপ ও প্রপ্সের সুচিন্তিত ভাবনার জন্য যারা দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের কুর্ণিশ না জানিয়ে পারা যায় না।

কিছু দৃশ্য মনে দাগ রেখে গেছে অনিবার্যভাবে। চোরকে মারার স্থির দৃশ্যটি খুব সুন্দর। জগিং করারত দুটো চরিত্র দেখার মতো। একটা হাল্কা হাওয়ার মত বয়ে গিয়ে দৃশ্যের পটবদলে সাহায্য করেছে এই জগিং দৃশ্যটি। আলোর কারসাজিতে তৈরী রাতের বহুতলবাড়ী(স্কাইক্রেপার) চমকপ্রদ। নাটকটিতে আলো ও সঙ্গীত ব্যবহার ছিল খুব শিল্পসম্মত। পরিচালকের মুন্সিয়ানা মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।
চোর’ নাটকে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাবার ক্ষেত্রে আরেকটু কম সময় নিলে পুরো নাটকটির বহমানতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকত।

পোষাকে মুনমুন সেন, সেট্-এ ভাষ্কর ভৌমিক, প্রোডাকশন ম্যানেজার/লাইটিং এ কল্লোল নন্দী, প্রডাকশন এসিসট্যান্ট দেবু বাসু, প্রপস্ ম্যানেজার কৌশিক বাসু, সহকারী রাজীব দে, মেক্ আপ্-এ মোহনা মিত্র দাস, করি গিয়েসেন ও শন্ কলিন্স সকলকে নিয়ে একটা টিম স্পিরিট কাজ করেছে সুসম্পন্ন ভাবে যা পরিচালকের সুচারু নেতৃত্ব স্পষ্ট করে।

এই নাটকটি দর্শক হৃদয়ে এধরণের আরো ছোটগল্প-ভিত্তিক রমণীয় নাটক দেখার প্রত্যাশা ও আগ্রহ জন্মালো ও জাগালো। পরিচালকের কাছে নিবেদন যে আমাদের এই স্ট্রেসের ভুবনে, এরকম নির্মল আনন্দ দেয়া মন-ফুরফুরে নাটক আরো হোক।