Dui Hujoorer Goppo (2017)- Review (Bengali)

নাটক সমালোচনা : ‘দুই হুজুরের গপ্পো ‘

:: শুভশ্রী নন্দী (রাই)

[শুভশ্রী নন্দী নিয়মিত ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল ও অন্যান্য পত্রিকা জন্য লেখেন।]


বছর ঘুরে আবার মার্চ মাস। সেইন্ট পেট্রিক্স এর সবজে গন্ধ সবে যাই যাই । গ্রাউন্ড হগ ‘বসন্ত এসে গেছে’ -কিনা-র হদিস নিতে ব্যস্ত। সেই সময় আটলান্টার নাট্যপ্রেমীদের নড়ে চড়ে বসার মাহেন্দ্রক্ষণ । বাতাসে বাতাসে ভাসছে জোড় মহড়ার খবর । এ.টি. ডাব্‌ল্যু-এর শামিয়ানার তলায় শ্রী রক্তিম সেনের নেতৃত্বে লড়ে যাচ্ছে আঠেরো জনের আটলান্টার নাট্য সৈন্যদল । দশাসই সেটের খবর দশ দিগন্তে । অবশেষে ‘প্রতীক্ষার হইল যে শেষ’। তারিখ ১৮ই মার্চ ২০১৭। সোনালী রোদ্দুরে মোড়া রেড ক্লে এবং শেষ শীতের বিকেল।

গরম সিঙ্গারা ও চপের সাথে চায়ের ধোঁয়ায় মেজাজটা মুচমুচে ও চনমনে । মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই । এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় জয় শ্রী রক্তিম সেনের নেতৃত্বে আটলান্টা থিয়েটার ওয়ার্কশপের-যে তারা আটলান্টার মাটিতে একদল নাট্য মুগ্ধ শ্রোতা তৈরী করতে পেরেছে । ঋচা সরকারের নিজস্ব স্টাইল থেকে বেড়িয়ে আসা ঝরঝরে উপস্থাপনার পর দুই হুজুর ও তাঁদের গপ্পো নিয়েই এই নাটক ‘ দুই হুজুরের গপ্পো ‘। এই নাটকটির ‘core ‘ বিষয় বস্তুতে অনেক ডাইমেনশন রয়েছে- হ্যাভস -হ্যাভ নটস, সভ্যতার সারল্য ও জটিলতা, শিল্পায়ন ও কৃষি নির্ভরতা, নাগরিক ও গ্রাম্য জীবন।

কিন্তু এই সমস্ত অতিসরলীকরণ আপাময়তা ছাপিয়ে যে মূল বক্তব্য পতাকা তুলে মাথা উঁচু করে রয়েছে- তা এই নাটকের ভাষায় সাদা সাপটা বলতে গেলে -রসবোধের মোড়কে মূল্যবোধের খাট্টা-মিঠা ‘আমসত্ব’। রসবোধ অন্তঃসারে গ্রহণ করতে গেলেই চাবুকের কশাঘাতের মতো ভ্যালু-সিস্টেম গিলতেই হবে । এ যেন ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’ । তাই সমকালীন স্বার্থসংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক যুগের অবয়বে এই ধরণের একটা সময়োপযোগী নাটক কালোপযোগী করে নির্বাচন ও উপস্থাপনা খুবই যুগোপযোগী। নাট্যকার চন্দন সেন কে ধন্যবাদ যে কপিরাইটটির অধিকার যোগ্য রূপকার রক্তিম সেন কে দেয়ার জন্য- কারণ রতনে রতন না চিনলে এহেন স্বার্থক রূপায়ণ সম্ভবপর হতো না।

আটলান্টা থিয়েটার ওয়ার্কশপের এটি অষ্টম গর্ভের সন্তান নয়, নবম সন্তান এই ‘দুই হুজুরের গপ্পো’। আমার ন’ টি নাটকই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার পছন্দের তালিকার প্রথম দুটি-র মধ্যে ‘একটি অবাস্তব গল্প ‘ ও ‘দুই হুজুরের গপ্পো’- কোনটি শ্রেষ্ঠ- তা নিয়ে একটি সুচিন্তিত বিতর্ক সভা ও আলোচনায় একটি সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেতে পারে।

কাকতালীয় ভাবে দুটির মধ্যেই ‘গপ্পো’ জড়িয়ে আছে। আলোকসম্পাত, দৃশ্য পটের সেট, আবহ সংগীতের সুর মূর্চ্ছনা ছিল ‘আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ‘ । এই ত্রয়ীর স্বার্থক যুগলবন্দী অনেক সময়ই নাটকটির স্বার্থকতার ক্ষেত্রে, নাটকটির কাঠামো ও ব্যক্তিত্ব তৈরির ক্ষেত্রে, আলাদা আর্ট ফর্মের আইডেন্টিটি ছাপিয়ে, ইংরেজি সাহিত্যের ভাষায় ‘পার্সোনিফাইড’ বা উজ্জ্বল চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্দ্বিধায়, এই নাটকটি গ্রূপ থিয়েটার এর যথার্থ সংজ্ঞার উদাহরণ। শুরুর দৃশ্যে, পার্কের সামনে ইন্ট্রোডিউসড হলেন ‘দুই হুজুর’। দৃশ্যকল্প, আবহ, মুড্, আলো- সব দেখে বলতেই হয়, ‘সাধু সাধু’। আহা এমনি একটি দৃশ্য আটলান্টার ‘রেড ক্লে’ আর কলকাতার ‘একাডেমি’র স্থান নির্ভর কাল-মুহূর্ত সব গুলিয়ে দেয় । মুখ্য চরিত্র দুটিকে এস্টাব্লিশ করতে এর চাইতে ভালো দৃশ্যকল্প আর কিছুই হতে পারতো না। আর ঠিক চরিত্র দুটোকে গুলে খেয়ে অভিনয় করার মতো দুই অভিনেতার পাত্র নির্বাচন দেখে পরিচালককে বলতেই হয় যে ‘জহুরী জহর চেনে।’

এই নাটকের নায়ক ‘দুই হুজুর’ -গজানন ও বক্রেশ্বর । অতুলনীয় অভিনয়। এই দুই চরিত্রটি কিন্তু সংলাপ নির্ভর। যেহেতু পুলিশ এবং পলিটিশিয়ান – ‘জোড় যার মুলুক তার’ এর দুটো ‘মেইন- স্ট্রিম’ সামাজিক অবক্ষয়ের অবয়বের একটা চিত্র ধরে তুলতে ও চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলতে- ‘সংলাপ’- ই চরিত্র ফোটানোয় একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে নিশ্চয় । কিন্তু সেই সংলাপ কে মূর্ত ভূমিকায় উজ্জ্বল করে তুলেছে তাঁদের শক্তিশালী অভিনয়।

টিপিক্যাল কাঁধে ঝোলা হাতে আমসত্ব বিক্রেতা বেকার আনন্দের উপস্থিতি ও অভিনয় একটা পূর্ণতা দিয়েছে শুরুর দৃশ্যপট টিকে।

এরপর অনুক্ত অনুচ্চারিত ‘শুন্ডি না হুন্ডি’? এডজাস্ট ও একোমোডেশন এ নীতিহীনতায় বাসের সভ্যতা বহির্ভূত এক দ্বীপ। দৃশ্যপটে সত্য ঢালী ও দূর্বা। সত্য ঢালীর নামটিই এক ব্যঞ্জনা বহন করছে। এঁদের অসাধারণ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ফেশিয়াল কার্ভ লাইন এর প্রকাশ ভঙ্গি বুঝিয়ে দিয়েছে যে এক ভাষা ও জাতিত্বের ভাগিদার হলেও ‘দুই হুজুর’ এর সাথে তাঁদের যেন দুই পৃথিবীর দূরত্ব- যেন তাঁরা দুই দ্বীপবাসিনী। এখানেই ক্লাস কনফ্লিক্ট বা নীতি সংগ্রামের একটা পরিষ্কার আভাস নাটকটির থিমটির কেন্দ্রবিন্দু জাস্টিফাই করে দিচ্ছে । দুই হুজুরের উপস্থিতিতে গপ্পটি যে অন্য মাত্রায় গাঁথা বা অন্যদিকে মোড় নিতে চলেছে তা এই মুহূর্তটি ই স্থিরধার্য্য করে দিল। সারা নাটক জুড়ে গ্রূপ-সীনে দূর্বার এক পংক্তির সংলাপ বা কান্না নাটকটি কে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে । অন্য দৃশ্যে সত্য ঢালী ও জ্ঞানখুড়োর পাওয়ার স্ট্রাগল বা ক্ষমতার লড়াই এর ‘সংলাপ-পাঞ্জা’, জ্ঞানের গভীরতায় নির্লিপ্তি ও ঔদ্ধত্যের বৈপরীত্য খুব স্পষ্ট করে ধর্ম-অধর্ম, শুভ-অশুভর লড়াই এর দ্বন্দ্বের জায়গাটির স্পষ্ট চিহ্নয়ন সম্ভবপর করেছে । সত্য এবং দূর্বা -এই দুজনকে কেন্দ্র করেই সারা গ্রামটির চালচিত্র ও চরিত্র একটু একটু করে অবয়ব নেয়।

জ্ঞান খুড়ো কে ঘিরে সমগ্র গ্রামটির চালচলন যেন আমাদের ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ -র কথা মনে পড়িয়ে দেয় । জ্ঞান খুড়ো যেন সেই সবুজ দ্বীপের রাজা। তাঁর সেই দাপটি অথচ পরিমিত সংযত অভিনয়ে শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন গোটা গ্রামের কখনো বিদ্রোহ, কখনো আক্ষেপ আর কখনো অসন্তোষ বা বিহ্ববলতা । জ্ঞান খুড়ো প্রতিশোধ স্পৃহাহীন অথচ জীবন খেলার ঝুঁকি তে অনায়াস অভ্যস্থতার এই বৈপরীত্য নিয়ে একটা সংযত জীবন স্থাপন এর কঠিন চরিত্র খুব সুন্দর ভাবে ফোটাতে পেরেছেন ।

আকাশ সত্যিই খোলা আকাশের একটি নির্মলতা সুক্ষভাবে চরিত্রে ফোটাতে পেরেছে -যেন একমুঠো দমকা হাওয়া। অন্যরূপে ইউকেলেলিতে খোলা গলায় সংগীতের যথাযথ ব্যবহার তার চরিত্রের নির্মলতা আরো স্পষ্ট করে তুলতে আরো সাহায্য করেছে । সমরেশ মজুমদার তাঁর ‘কালবেলা’ উপন্যাসে বলেছিলেন যে দশ বছরের বাচ্চাদের রেখে বাকিরা এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে, একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। আকাশ চরিত্রটি সেই উপন্যাসের সংলাপ বারবার মনে করাচ্ছিল ।

ভুবনের কনফিউশন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মনে করিয়ে দেয় যে যেকোনো চোরাবালি একটা উইকেস্ট লিংক বা দুর্বল সূত্র ধরে ঢুকে পড়তে পারে। ভুবন নির্দ্বিধায় সেই দোটানা, দ্বিধা ও ‘ইসি ট্র্যাপ’ এর ভূমিকা নির্দ্বিধায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।

টগর চরিত্রটি ভুবনের মনের টানাপড়েন বা অন্তর দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে এবং টুংলি ও টগর এর মধ্যে পডে যাওয়া ভুবন ও এই এয়ীর অভিনয়- ত্রিভুজ , বহু বছর আগের একটা হারান সুর মনে পড়িয়ে দিল, “যাকে চাই তাকে পাই না, যাকে পাই তাকে চাই না ।” …. হাল্কা এই চটুল গানটি হয়তো যা পারেনি, টগর চরিত্রটির উপস্থিতি এই দৃশ্যটি দিয়ে জীবনের মহা মূল্যবান কথা বলে দিয়ে গেছে! কবিগুরুর ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না’ ভাবনার প্রতিফলনে দৃশ্যটির উওরণ ঘটেছে সেখানে।

বংশী ও তার স্ত্রী সুধন্যার অসাধারণ মুখের অভিব্যক্তি ও অভিনয়ের বলিরেখায় বেদনা-স্পষ্ট প্রকাশ নাড়া দিয়েছে দর্শককে। স্পর্শ করেছে ব্যাথা -যে ব্যাথা সংক্রামিত হয়েছে দর্শক মনেও।

এ ছাড়া নীতি আঁকড়ে থাকা সহজ জীবনবোধের টুঙলি – গড়ে ওঠে স্বাধীন মতামত ও তাকে নির্ভর করে বেড়ে ওঠা বিশ্বাসে । সে ও তাঁর মা তাঁদের নিজস্ব চরিত্র অনুসারে মধ্যবিত্ত সমাজভিত্তিক দর্শকদের মন ছুঁয়ে যেতে পেরেছে- যে সমাজে অন্যায়ের শাস্তি আছে, স্বাধীনভাবে ভাবার অধিকার আছে। স্বপ্নের রামরাজত্বের এই অদম্য ইচ্ছের আদর্শগুলো যেন আকাশ ফানুস না হয়ে চরিত্র হয়ে ঘোরাফেরা করছে মনের প্রলেপ জুগিয়ে। ফাগুলাল, হলধর, টগর , সাগর, রতনেরা আদর্শের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কঠিন পথটি অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চরিত্রণানুযায়ী ফুটিয়ে তুলেছে যে যার মতো করে ।

অবস্থানের জটিলতায় দেখা গেছে যে বংশীর মতো কামিয়াব ও কর্মনিষ্ঠ মানুষকেও সত্যভ্রষ্ট হয়ে হেলে যাবার চরম মুখে ঠেলে দিয়েছে সভ্যতার ধারালো দাঁতের বিষ মাখানো রাজনৈতিক চিন্তার ফলা । যেখানে মস্তিষ্ক সরলভাবে রাস্তা ধরে হাঁটাই ভুলে গেছে । বক্রপথেই তাঁর ইন্টেলেকচুয়াল জয় ও কামিয়াবি । এই চরিত্র গুলোকে নিয়েই তাঁদের তৈরী নানা দৃশ্যপটে গ্রূপ থিয়েটারের একেবারে উচ্চস্তরের মুন্সিয়ানা দেখতে পেরেছেন পরিচালক।

রক্তিম সেনের ইমানদার বা ক্লাসি নাটকের প্রোডাকশনের বৈশিষ্ট এই যে তিনি অভিনয় সম্ভাব্য চরিত্রগুলোকে এবং কলাকুশলী কে এক বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে নাটকের সার্থক রূপায়ণ ঘটাতে পারেন এবং যার ফলে চরিত্রগুলো বিভিন্নতায় শুধু নয়, শরীরী ভাষা ও ম্যানারিজম নিয়ে প্রকাশভঙ্গিতে থাকে উজ্জ্বল। দূর্বার গ্রামবাসীদের ডাক দেয়ায় সারল্য মাখানো হাতছানি , সুধন্যার চোখের কোণে আটকে রাখা চোখের জল, দুই হুজুরের সরল মানুষদের মধ্যে হিংসা-প্রতিযোগিতার প্রবণতা উস্কে দেয়ার চারিত্রিক শ্রুডনেস -এর মতো ভুড়ি ভুড়ি উদাহরণ রয়েছে এই নাটকটিতে। ভাষা পুব বাংলার হলেও প্রত্যেকটি চরিত্রের মুখে সেই ভাষা নিজস্বতা নিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। হলফ করে অনুমান করা যায় যে এর পেছনে পরিচালকের অনেক সময় ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টাই চরিত্রায়নকে সফল করতে সাহায্য করেছে।

আহা ! আলোর ব্যবহারে কি বা ভাবনা-চিন্তা, কিবা ডিটেইলিং। ধামসা মাদল নিয়ে নাচের দৃশ্যটি একটি কমপ্লিট বা পরিপূর্ণ দৃশ্য । আধভাঙা চাঁদ, তারাভরা রাত, সমুদ্দুর, অগ্নিভা, সেলুলয়েড এর এফেক্ট – কত উদাহরণ দিই ? যেন ‘আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি “। যেমন আগ্নেয় আলোর প্রভা অনেক অভিব্যক্তি প্রকাশে সাহায্য করেছে -সমুদ্রের নীলাভ আলোও তেমনি রূপক হয়ে ব্যবহৃত হতে দেখা গিয়েছে নাটকের বিষয়বস্তুর অঙ্গ হিসেবে। মনে রাখতে হবে যে একটি চলচ্চিত্রের ক্যামেরার ফ্লেক্সিবিলিটি প্রশ্নাতীত । নাটকে তার আলো ব্যবহার এত সিন্যামাটিক যা দেখে বিস্মিত হতে হয় । নাটকে সেই অসম্ভব কে সম্ভব করেন রক্তিম সেন। আলো ও সেটআপ এর মুন্সিয়ানা ও গাঁথুনিতে দৃশ্য উপস্থাপনা এত উঁচুদরের, ফ্ল -লেস , নিঁখুত-নিপাট ছিল যে আবার মনে করিয়ে দিলো ‘একটি অবাস্তব গল্পের ফাঁসির দৃশ্যকল্পের সেই রক্তিম আলোকসম্পাত।

যে সার্থক দৃশ্যের ছবি আমরা দেখি উঁচুদরের সাহিত্য পত্রিকার নাট্য সমালোচনার পাতায়, তেমনি একটি দৃশ্য জ্ঞানখুঁড়ো কে নিয়ে বিচার সভা । এই চোখ জুড়ানো দৃশ্যটি বহুদিন আমাদের মনে গাঁথা থাকবে গ্রূপ থিয়েটারের চিরন্তন নিদর্শন হয়ে ।

কল্লোল নন্দীর সেট এক কথায় জ-ড্রপিং । ডিটেইলিং এখানে একটা সুস্পষ্ট ভাবনা ও চিন্তনের প্রকাশ হিসেবে শক্ত পোক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে। কস্টিউম খুবই ‘যত স্থানে যদাচার “। উঁচুতারের অঙ্কনে ডিটেইলিং ও নিখুঁত নিপাট । দৃশ্যপট পরিবর্তনের তৎপরতায় ও প্রপ্স স্থানান্তরে দেখা গেছে পেশাদারিত্ব ।

সমালোচনা সমালোচকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তাই দু-একটি প্রসঙ্গ মনে এলো। বক্রেশ্বর গেট আপ এ সুঠাম দেহ পুলিশের চরিত্র কে এস্টাব্লিশ করলেও মেক -আপ এ আরেকটু বয়স্কতার টাচ পড়লে ‘রিটায়ার্ড’ ব্যাপারটি আরো যুক্তিবদ্ধ সুনিশ্চিত হতো এবং গজাননের বয়সোচিত সমান্তরাল বন্ধুত্ব ও দর্শকের চোখে আরো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন দৃঢ় করতো।

দ্বিতীয়তঃ কলকাতার নাটকগুলোতে ইদানিং দুটি বিষয় খুব চোখে পড়ে : এক সংলাপ নিক্ষেপনে দ্রুতময়তা ও দুই নানা রকম মঞ্চ সজ্জায় লেভেলিং এর ব্যবহার। এ ক্ষেত্রেও সেটিং এ লেভেলিং এর ব্যবহার হয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে একবার সর্বোৎকৃষ্ট ও সফল ব্যবহার দেখা গেছে জ্ঞান খুড়োর বিচার সভায় যখন বংশীর বিরুদ্ধে সালিশি চলছে। সেই ক্ষেত্রে তিনটি লেভেল ব্যবহৃত হয়েছে -যেমন জ্ঞান খুড়ো একটি লেভেল এ, আরেক লেভেল এ কিছু গ্রামবাসী দাঁড়ানো ও অন্য লেভেল এ কিছু গ্রামবাসী বসা। গ্রূপ থিয়েটার এর একটা সার্থক চিত্রায়ন তৈরী হয়েছে সেখানে। স্টিল ফটোগ্রাফ ও ভিডিও ক্লিপ হয়তো আমার বক্তব্য আরো স্পষ্ট করবে।

এই ‘দুই হুজুরের গপ্পো’ একটি পরিপূর্ণ নাটক। শেষ দৃশ্যটি দেখেও পুলক জাগে – মনে হয় সেই বিখ্যাত উক্তি,”মহৎ কিছু দেখিলে উল্লাস আসে।” সেই পার্কর পরিবেশে ভিনদেশী চরিত্রগুলো কেমন দৈনন্দিন হয়ে গেছে। শ্রী রক্তিম সেনের নাটক দেখে আটলান্টায় আমি-ই প্রথম বলেছিলাম যে আটলান্টায় বসে ‘একাডেমি’ দেখছি । আজ সেটা সারা আটলান্টা বলে।

আজ আরো একটি কথা প্রথমবার উচ্চারণ করতে চাই, যা পরে হয়তো অনেকে অনেকবার বলবে যে , শব্দ, আলো , চরিত্রায়ন সব মিলিয়ে নির্দেশনার একটা কমপ্লিট প্যাকেজ দাঁড় করানোয় একজন পরিচালকের যতটুকু দখল ও জ্ঞান থাকা দরকার -এতগুলো ‘জনর’ এ তার পারদর্শীতা দেখে তাঁকে কুর্নিশ ও কুডোস জানাতেই হয় । নিজের মধ্যে এত ভিন্নধর্মী প্রতিভার সহাবস্থান যেমন আলো, শব্দ-সংগীত-পরিচালনা এত সফল ও সনির্ভরভাবে করার দৃষ্টান্ত হয়তো সমগ্র বাংলা নাট্যজগতে তিনি একা বা গুটি কয়েকের এক। কলকাতায় যখন বাঘা বাঘা নাট্য পরিচালক নাটক করতেন, তখন আলো করতেন তাপস সেন, সংগীত দেখতেন তেমন তাবড় তাবড় শিল্পী । শ্রী রক্তিম সেন ইস ‘ফোর-ইন-ওয়ান’। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় যখন তিনি তাঁর দলের অভিনেতা কে মেঘনাদ সাহা কিভাবে পরিচালনা করেছিলেন এক ই নাটক-তা নিয়ে আলোচনা করেন নিজস্ব প্রযোজনা মঞ্চে উপস্থাপনার পর। এটাই হচ্ছে জিনিয়াস এর লক্ষণ। এই জন্যই তিনি রক্তিম সেন।

সমগ্র শিল্প জগতে দেখা দিচ্ছে এক সংকট । তথাকথিত ‘পারফর্মা’র নামে এক শ্রেণীর মধ্যমেধার সীমাবদ্ধতা দেখা যায় । এই মধ্য মেধার কালচার নিয়েই গড়ে উঠেছে অরিজিন্যাল ভেঙে, আবার অরিজিন্যাল কে আশ্রয় করে সুকুমার রায়ের ‘হাঁসজারু’ প্রজাতির ‘ফিউশন’ । এই মধ্য মেধা দের প্রবণতাতেই গড়ে উঠছে ‘রিমেক কালচার’ উত্তম সুচিত্রার মুভি ই হোক বা অন্য কিছুই হোক। লতা কন্ঠী ও কিশোর কন্ঠীতে ভরে যাচ্ছে অনুকরণের আকাশ। এদের ক্ষেত্রে মধ্যমেধার সীমাবদ্ধতাই মৌলিক ও সৃষ্টিধর্মের বাধা হয়ে দাঁড়ায় । রক্তিম সেন ব্যতিক্রম বলেই তার সৃষ্টির আকাশ এত ব্যাপ্ত আর সেই সৌভাগ্যে আটলান্টা লক্ষীমন্ত। এরকম খুব তাড়াতাড়ি আরেকটি সৃষ্টিমূলক কাজের সাক্ষী হওয়ার জন্য বছরের বাকি দিনগুলোর প্রতীক্ষা নির্দ্বিধায় সহজ হয়ে যায় । দুই হুজুরের পরের গপ্পটি নাটকে দেখার অপেক্ষার পালা আমাদের ।

Play Reviews